বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২৮ পূর্বাহ্ন
মাওলানা আশরাফুল ইসলাম:
স্বপ্ন মানবজীবনের এক বিস্ময়কর ও গভীর রহস্যময় দিক, যা আদিকাল থেকেই মানুষের কৌতূহল ও চিন্তাকে নাড়া দিয়েছে। সবচেয়ে মহিমান্বিত স্বপ্ন হলো, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখা। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, শয়তান কখনো তার রূপ ধারণ করতে পারে না, তাই তাকে স্বপ্নে দেখলে তা নিঃসন্দেহে সত্য। এ স্বপ্ন কেবল আধ্যাত্মিক আনন্দই দেয় না, বরং তা জীবনকে বদলে দেওয়ার মতো প্রেরণা জোগায়। তবে নবীজিকে স্বপ্নে দেখার সৌভাগ্য অর্জনের জন্য অন্তরে তার প্রতি গভীর ভালোবাসা, সুন্নতের অনুশীলন এবং অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রাজ্ঞ আলেমরা।
পবিত্র কোরআন ও সহিহ হাদিসে স্বপ্নের গুরুত্ব ও প্রকারভেদ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বপ্নকে নবুয়তের একটি অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা মুমিনের জন্য সুসংবাদ ও ইমান বৃদ্ধির কারণ। বহু হাদিসে সত্য স্বপ্নের মর্যাদা ও তার প্রভাব বর্ণিত হয়েছে। বিশেষ করে মুমিনের জন্য সত্য স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত স্বরূপ, যা তার অন্তরে আশা, সাহস ও সুস্থ চিন্তার জন্ম দেয়।
ইতিহাসে দেখা যায়, ইউসুফ আলাইহিস সালাম ও তার সমসাময়িকদের জীবনে স্বপ্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি অবিশ্বাসী ও পাপিরাও কখনো কখনো সত্য স্বপ্ন দেখে থাকে, যদিও তা নবুয়তের অংশ হিসেবে গণ্য হয় না। এসব স্বপ্ন হয় সতর্কবার্তা, নয়তো সৎপথে ফেরার আহ্বান। তবে মুমিনের স্বপ্ন ও অবিশ্বাসীর স্বপ্নের মান ও তাৎপর্য এক নয়, এটা আলেমরা স্পষ্ট করে বলেছেন।
সত্য স্বপ্ন : সত্য স্বপ্ন নবুয়তের অংশ। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি। সুসংবাদ বহনকারী বিষয়াদি ছাড়া নবুয়তের আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, সুসংবাদ বহনকারী বিষয়াদি কী? তিনি বলেন, ভালো স্বপ্ন। (সহিহ বুখারি ৬৯৯০) অন্য হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, মুমিনের স্বপ্ন নবুয়তের ৪৬ ভাগের এক ভাগ। (সুনানে তিরমিজি ২২৭১)
মুমিনের জন্য সুসংবাদ : সত্য স্বপ্ন মুমিনের জন্য সুসংবাদ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা ইমান আনে ও তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য আছে সুসংবাদ দুনিয়া ও আখেরাতে, আল্লাহর বাণীর কোনো পরিবর্তন নেই, এটাই মহাসাফল্য।’ (সুরা ইউনুস ৬৩-৬৪) রাসুলুল্লাহ (সা.) আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘সুসংবাদ হলো সত্য স্বপ্ন, যা মুসলিম ব্যক্তি দেখে বা তাকে দেখানো হয়।’ (সুনানে তিরমিজি ২২৭৩)
অবিশ^াসীদের সত্য স্বপ্ন : পাপী ও অবিশ্বাসীরাও সত্য স্বপ্ন দেখতে পারে। যেমন ইউসুফ (আ.)-এর যুগের বাদশাহ ও তার জেলের দুই সঙ্গী অবিশ্বাসী হওয়ার পরও সত্য স্বপ্ন দেখেছিলেন। তবে সেই স্বপ্ন নবুয়তের অংশ নয়। কাজি আবু বকর ইবনুল আরাবি (রহ.) বলেন, মুমিনের স্বপ্ন নবুয়তের অংশ, পাপীর স্বপ্ন নবুয়তের অংশ নয়। আর কাফের বা অবিশ্বাসীর স্বপ্ন ভিত্তিহীন। (ফাতহুল বারি ১২/৩৬২)
হাফেজ ইবনে হাজার আস্কালানি (রহ.) বলেন, যখন কোনো অবিশ্বাসী বা পাপী সত্য স্বপ্ন দেখে সেটা হয়তো তার সুপথ লাভ ও তাওবার সুসংবাদ অথবা কুফরি ও পাপের ওপর অটল থাকার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি। (ফাতহুল বারি ১২/৩৮১)
স্বপ্নে নবীজিকে দেখা : নবীজি (সা.)-কে স্বপ্নে দেখা মুমিনের জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। কেননা তাকে স্বপ্নে দেখা বাস্তবে দেখার মতোই সৌভাগ্যের। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে আমাকে স্বপ্নে দেখল, সে যেন আমাকে জাগ্রত অবস্থায়ই দেখল।’ (সুনানে আবু দাউদ ৫০২৩)
সাধারণত আল্লাহভীরু ও নবীপ্রেমিক মুমিনরাই নবীজি (সা.)-কে স্বপ্নে দেখে। অবিশ্বাসী ও পাপীরা স্বপ্নে নবীজি (সা.)-এর সাক্ষাৎ পায় না। তবে পাপী ও অবিশ্বাসীদের নবীজি (সা.)-এর সাক্ষাৎ পাওয়া অসম্ভব নয়। শায়খ আবদুল্লাহ বিন বাজ (রহ.) এ বিষয়ে বলেন, নবীজি (সা.)-কে স্বপ্নে দেখার জন্য তার অনুগত হওয়া শর্ত নয়। তবে মুমিনের স্বপ্ন আর ফাসেকের স্বপ্নের তাৎপর্য সমান নয়।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘যারা সৌভাগ্যবান কেবল তারাই রাসুল (সা.)-কে স্বপ্নে দেখতে পারেন। কিন্তু যারা তাদের দলভুক্ত নয়, তাদের স্বপ্নে দেখার বিষয়টি সত্য হতেও পারে, আবার মিথ্যাও হতে পারে। তবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য অর্জিত হবে কিতাব ও সুন্নতের অনুসরণের দিক বিবেচনা করে। যিনি কিতাব ও সুন্নতের অনুসারী হবেন তার স্বপ্ন সত্য হবে, আর যিনি কিতাব ও সুন্নতের অনুসারী হবেন না, তার স্বপ্ন মিথ্যা হবে।’ (ফাতহুল বারি ১২/৩৮৫)
মুমিনরা স্বপ্নে নবীজি (সা.)-কে দেখলে যেমন সংশয় থাকে না, পাপীরাও তাকে দেখলে কোনো সংশয় থাকে না। কেননা শয়তান রাসুল (সা.)-এর আকৃতি ধারণ করতে পারে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে স্বপ্নে আমাকে দেখল সে আমাকেই দেখল। কেননা শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না।’ (সহিহ বুখারি ৬৯৯৪)
স্বপ্ন সত্য হয় যেভাবে : সত্য স্বপ্ন মুমিনের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশনা প্রাপ্তির মতো। তাই মুমিনের জীবনে সত্য স্বপ্ন প্রার্থিত বিষয়। মহানবী (সা.) সত্য স্বপ্ন লাভের আমল বলেছেন, তা হলো সত্য বলা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, সময় যখন কাছাকাছি হবে তখন মুসলিমের স্বপ্ন মিথ্যা হবে না এবং যে যত সত্যবাদী হবে তার স্বপ্নও তত সত্য হবে। স্বপ্ন তিন প্রকার। এক. উত্তম স্বপ্ন, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। দুই. ভীতিপ্রদ স্বপ্ন, যা শয়তানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। তিন. যে স্বপ্ন মানুষ চিন্তা-ভাবনা ও ধারণা অনুপাতে দেখে থাকে। (সুনানে আবু দাউদ ৫০১৯)
স্বপ্ন ইসলামে কেবল এক মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক বিষয় নয়, বরং তা হতে পারে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক মূল্যবান বার্তা। সঠিক আকিদা, সত্যবাদিতা ও নেক আমলের মাধ্যমে মুমিন এই বরকতময় স্বপ্ন লাভ করতে পারে। মুমিনের জীবন পরিচালনায় এবং ইমান দৃঢ় করতে স্বপ্ন এক অনন্য মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়।
ভযেস/আআ